দোলাচল
-সুমিতা দাশগুপ্ত
সকাল থেকে রক্ষিত বাড়িতে মহা হুলুস্থূল পড়ে গেছে। সকাল থেকে বীরেনবাবুর চুণীর আংটিটা গায়েব। আংটিটা আঙুলে একটু ঢিলে হওয়ায়, স্নানের আগে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলের উপরে খুলে রেখে গিয়েছিলেন। স্নান সেরে ফিরে এসেই , আঙুলে গলাতে গিয়ে দেখেন সেটি গায়েব।আশ্চর্য! তাঁর ঘরে ঢুকে আংটিটা সরাবে কে! ঐ আংটির উপরে বীরেনবাবুর দূর্বলতার কথা বাড়ির সবাই জানে। তাঁর গুরুদেব গ্রহাচার্য তুরীয়ানন্দ শাস্ত্রী মহাশয়, বীরেন বাবুর কোষ্ঠিবিচার করে, তাঁর কুপিত গ্রহশান্তির জন্য ঐ চুণীর আংটিটি ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বীরেনবাবু গুরুবাক্য অমান্য করেন নি। তড়িঘড়ি আংটিটি বানিয়ে এবং গুরুদেবকে দিয়ে শোধন করিয়ে নিয়ে ধারণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
ধারণ করার পর অচিরেই সুফলও ফলতে শুরু করে দিয়েছে, এই যেমন বাগানের আমগাছটায় এতোদিন ফল ধরে নি, এইবারই প্রথম তাতে মুকুল ধরলো, ছোট ছেলেও একটা ভালো চাকরির অফার পেয়েছে। আগের রান্নার লোকটি ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দেবার পর নতুন যাকে পাওয়া গেছে তার রান্না অমৃততুল্য, বড় নাতিটি ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রথম সেমিস্টারে দারুণ রেজাল্ট করেছে, এইসব তো আর ফেলে দেবার জিনিস নয়, আর আজ এই যে তিনি আমন্ত্রণমূলক বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করতে চলেছেন, তাও কী কম সম্মানের!
বীরেনবাবুর, আংটির উপরে নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে ওটি ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতেও সাহস হচ্ছিল না তাঁর। কে জানে কোথায় কোন বিপদ ওঁত পেতে থাকে!
অজানা আশঙ্কা ক্রমে ক্রোধে পরিণত হচ্ছিলো। মুখে খাবার রুচছিলো না। পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে গড়াচ্ছে, এমন সময়ে বড় নাতি এসে আংটিটি এগিয়ে দিল।
উচ্ছ্বসিত বীরেনবাবু দ্রুত আংটিটি আঙুলে গলিয়ে নিয়ে, নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন।
“কোথায় পেলি? আজ রাতে তোকে তো একটা ট্রিট দিতেই হচ্ছে।”
“আমিই সরিয়ে রেখেছিলাম।” নির্বিকার ভাবে বললো নাতি।
“কী-ই- ই। কিন্তু কেন?” মুখ দিয়ে কথা সরছিল না বীরেনবাবুর।
“পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলাম, কতোখানি বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে এই বিজ্ঞানমঞ্চে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছ তুমি।”
“কী বলতে চাও, আমি একজন বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়ে বিজ্ঞানমনস্ক নই!”
“না নও, তাই তো দেখলাম। আসলে রাতজেগে পড়াশোনা করে যে বক্তৃতাখানা তুমি তৈরী করেছো সবটাই তোমার মুখের কথা, মুখস্থ বিদ্যা। নইলে ঐ একখানা পাথরের আংটি তোমাকে এই রকম নাকানিচোবানি কি করে খাওয়ায়!”
“তোমার এতো বড়ো সাহস, তুমি আমাকে তো বটেই, সেইসঙ্গে আমার গুরুদেবকেও অপমান করলে!”
“উঁহু, তোমার গুরুদেবকে তো আমি অপমান করি নি, তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন, তোমাকে সেই পথই দেখিয়েছেন, কিন্তু তুমি তো গুরুদেবের নির্দেশে আংটি ধারণও করেছো, অথচ বক্তৃতায় আজ যেটা বলতে চলেছো, সেটা তুমি নিজেই বিশ্বাস করো না। আমি শুধু তোমার এই দ্বিচারিতাটুকুই তোমায় ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।”
“সরে যা সামনে থেকে” বেজায় রেগে, নাতিকে সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন বিজ্ঞানমঞ্চ আয়োজিত সভায়, “সমাজে কুসংস্কারের কুফল” শীর্ষক বক্তৃতামালার আজকের প্রধানবক্তা বীরেনবাবু।
গাড়িতে যেতে যেতে, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হলো, নাতির কথার সারবত্তাটি এতক্ষণে একটু একটু করে মাথায় ঢুকছে। আসলে নিজেও যে বোঝেন না তা নয়, তবু কী করবেন, এই যুক্তি আর যুক্তিহীনতার টানাপোড়েনের হাত থেকে রেহাই পাবার পন্থা যে তাঁর জানা নেই। ঠিক ঐ রবিঠাকুরের কবিতার লাইনগুলো মতো — “নিজের হাতে নিজে বাঁধা,
ঘরে আধা, বাইরে আধা…”